ইতিহাস না আভিজাত্য ? সাক্ষী ইটাচুনা
ইটাচুনা রাজবাড়ি - সন্ধ্যা আরতির প্রাক্বালে |
" খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়া্লো , বর্গি এল দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে "
"when the kids sleep, silence set in the town,
But the Bargis creep in.
The bids have eaten the grains, how can I pay taxes?"
কথাগুলো শুনলেই আজন্ম পরিচিত শৈশব টা চোখের সামনে ঝমঝম করে বৃষ্টির দ্রুততায় পাস করে যায়। কে এই বর্গি? এই বর্গি হলো সেই সব অষ্টাদশ শতাব্দীর লুটতরাজপ্রিয় অশ্বারোহী মারাঠা সৈন্যদল, যারা অভিযানে যাওয়ার সময় কেবলমাত্র একটি সাত হাত লম্বা কম্বল ও বর্শা নিয়ে বের হত। এই বর্শাকে মারাঠি ভাষায় বলা হত বরচি। এই নাম থেকেই বারগির বা বর্গা বা বর্গি নামে পরিচিত হয়।
হুগলী জেলার পাণ্ডুয়া থানার অন্তর্গত গ্রাম ইটাচুনা! ইতিহাসের পাতায় এটি একদা বর্গিডাঙা হিসাবে পরিচিত ছিল। ইটাচুনা প্রাসাদের কাহিনী আমাদের বাংলার ইতিহাসের সেই সময়ের দিকে ফিরিয়ে নেয় যখন মারাঠা বার্গিরা তাকে বার বার লুট করছিল। এ সময় (১৮ শতকের মাঝামাঝি), বাংলায় নবাব আলীবর্দী খাঁ শাসন করেছিলেন। বর্গি নামে পরিচিত মারাঠা অশ্বারোহীরা সমৃদ্ধ জমি এবং করের সন্ধানে ১৭৪২ সালের দিকে শান্ত বাংলায় প্রবেশ করে। ভারতের ইতিহাসে তখন মোগল যুগ অবতীর্ণ হওয়ার পাশাপাশি মারাঠাদের স্বর্ণযুগ শুরু হয়। নবাব আলীবর্দী খান প্রথমবারের মতো তাঁর রাজত্ব বাঁচাতে বীরত্বের সাথে লড়াই করেছিলেন, কিন্তু আক্রমণগুলির পরিণতি ভয়াবহ ছিল। বাংলায় নেমে আসে দুর্ভিক্ষের ছায়া । এটি ভারতের ইতিহাসে অন্যতম বৃহত্তম গণ-সহিংসতা(Mass violence ) এবং ধ্বংসাত্মক ঘটনা।
১৭৫১ সালের বাংলার নবাব আলিবর্দি খাঁ মারাঠাদের সঙ্গে সন্ধি করেন। এই সন্ধিচুক্তি অনুযায়ী তিনি উড়িষ্যার অধিকার ছেড়ে দেন। এরপর বাংলায় বর্গি হানা বন্ধ হয়। বাংলার নবাব মারাঠাদের সাথে শান্তি চুক্তি করার আগে ১০ বছর ধরে বাংলার লুটপাট ও লুটপাট অব্যাহত ছিল। এই সন্ধির আগে বহুবার বর্গিরা বাংলার বুকে হামলা চালায় এবং মারাঠা বাহিনীর এই প্রভাবশালী আক্রমন ইতিহাসের পাতায় তার রেশ রেখে যায়।
তবে ইতিহাসের অন্যান্য যুদ্ধের মতো এই মারাঠা আক্রমণ বাংলায় একটি সাংস্কৃতিক চিহ্ন রেখে গেছে। সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ এবং প্রকৃতির অসামান্য সৌন্দর্য সম্ভ্রান্ত "বর্গিদের" ইটাচুনায় আটকে রাখে। তারা নিজস্ব বাণিজ্য শুরু করে, ধনী হয়ে ওঠে, স্থানীয়দের সাথে মিশে যায় এবং শীঘ্রই ‘বাঙালি’ বলে বিবেচিত হয়। ইটাচুনা রাজবাড়ি বাংলার একটি বর্গী ল্যান্ডলর্ড পরিবারের সম্পদ এবং প্রাচুর্য নিয়ে গর্ব বহণ করে। এ কারণেই ইটাচুনা রাজবাড়ি বর্গি ডাঙ্গা নামেও পরিচিত।
কলকাতা থেকে মাত্র দেড়-দুঘন্টা দূরত্বে ইটাচুনা রাজবাড়িটি হতে পারে এক -দুদিনের ছুটি কাটানোর আশ্রয়স্থল, যেখানে ইতিহাস ও আভিজাত্য একই মুদ্রার দুটি পিঠ।
শহরের সীমানা অতিক্রম করে মেঠো পথ ধরে গাছের ছায়ার আবেশে মাইলের পর মাইল সবুজে মোড়া চাষের জমি, কোলাহল মুখর দৈনন্দিন গ্রামীণ জীবনের ছন্দময় পথ শেষ হয় রাজবাড়ির বিশাল ফটকে। গেট ছাড়িয়ে ভিতরে পা দিলে কেমন যেন গা ছমছম করে ওঠে। জায়গাটি রাজকীয় পরিবেশে ঘেরা প্রকৃতি এবং আধুনিকতার এক নিখুঁত মিশ্রণ সরবরাহ করে।গুগুলের তথ্যাবলি থেকে জানা যায় এটি ১৭৬৬ সালে মারাঠা থেকে উত্থিত কুন্দন পরিবার প্রতিষ্ঠা করেছিল,যারা এখন বর্ন বিপর্যয় দ্বারা কুন্ডু নামেই বেশি খ্যাত।এনাদের মধ্যে থেকে শ্রী সাফল্য নারায়ণ কুন্ডু মহাশয় এই রাজবাড়িটি প্রতিষ্ঠা করেন বলে শোনা যায়,যেটি বর্তমানে হেরিটেজ হোটেল হিসাবে রূপান্তরিত হয়েছে।
রাজবাড়ি এমন একটি জায়গা যেখানে ইতিহাস বাস করে, লোকলস্কর পাইক বরকন্দাজ— কালের নিয়মে সেই অতীত জৌলুসের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই যদিও এখন। তাও পুরনো দেওয়ালের প্রাচীন গন্ধ, উঁচু কড়িবরগার ছাদ, আল্পনা দেওয়া বিরাট নাটমন্দির, প্রাঙ্গন জুড়ে বিরাট বিরাট বাতিস্তম্ভ, প্রকাণ্ড ঝাড়বাতি দিয়ে সাজানো ইতিহাসের গন্ধমাখা সুবিশাল বৈঠকখানা মুহূর্তে অন্য এক অনন্য জগতের দরজা খুলে দেয় চোখের সামনে।৷ এটি হয়ে যায় বহু হিন্দি এবং বাংলা চলচ্চিত্রের শুটিং লোকেশন - যেমন লুটেরা, পরাণ যায় জ্বলিয়া রে, রাজমহল ইত্যাদি ইত্যাদি ।
কি ভাবে যাবেনঃ
হাওড়া থেকে মেইন লাইনের বর্ধমানগামী বা পান্ডুয়া অথবা মেমারীগামী ট্রেনে খন্যান স্টেশনে নামুন। ব্যান্ডেল থেকে তিনটি ষ্টেশন পড়ে আদিসপ্তগ্রাম, মগরা, তালান্ডু তারপরেই খন্যান।
স্টেশন থেকে বেরিয়েই সামনে অটো, ভ্যান, রিকশা, ম্যাজিক সবই পাবেন, মাথাপিছু ১০-১৫ টাকায়। মিনিট ১৫ লাগবে রাজবাড়ি পৌঁছতে। আর গাড়িতে গেলে কলকাতা থেকে সোজা দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে বর্ধমানের দিকে যেতে হবে। বসিপুর, হালুসাই হয়ে পৌঁছে যান খন্যান স্টেশন। সেখান থেকে ইটাচুনা রাজবাড়ি মাএ ৩ কিলোমিটারের পথ। রাজবাড়ীর চেক-ইন হয় দুপুর ১২টা থেকে।
কি খাবেনঃ
কাঁসার থালায় ও ছোট বাটিতে দুপুরের নির্দিষ্ট মেনুগুলি সাজিয়ে পরিবেশন করেন স্থানীয় মহিলা কর্মচারীরা,যারা এখানে বংশ পরম্পরায় এই কাজের সাথে যুক্ত। দুপুরের মেনুতে লুচি, ফুলকপির তরকারি, ভাত, ঘি-সব্জি দিয়ে সোনা মুগ ডাল, ঝুরি আলুভাজা, আলু-উচ্ছে-বেগুন ভাজা, পুঁইশাকের তরকারি, পাঁঠার মাংসের এক বাটি ঝোল, স্যালাড, গন্ধরাজ লেবু সহযোগে কাঁচা পেঁপের চাটনি, দই, পাঁপড় ও শেষে মিষ্টি পান আপনাকে মুগ্ধ করবেই।সান্ধ্যকালীন স্ন্যাকস হিসেবে চিকেন/পনির পকোড়া বা মুড়িমাখা খেতে পারেন।
ডাইনিং টেবিল |
রাতে আপনি রুটি বা ভাত যেকোনো পদ নিতে পারেন সঙ্গে থাকছে আলুভাজা, মুগের ডাল, বাঁধাকপির তরকারি, কাঁচকলার কোপ্তা,পাঁঠা বা মুরগির মাংস, টমেটোর চাটনি, মিষ্টি । এগুলো ছাড়াও নিজের পছন্দমতো মিল আপনি মেনু দেখে বেছে নিতে পারেন।
সকাল ১০টায় চেক আউট হয়, তাই তার আগেই আপনি প্রাতঃরাশে পাবেন ফুলকো লুচি, বেগুন ভাজা, আলুর তরকারি ও কাঁচা গোল্লা; যা সত্যিই অমৃত সমান।
কি দেখবেনঃ
প্রবেশ বাড়ির সম্মুখভাগ ইট ও চুনের তৈরি ,আর সেই থেকেই ইটাচুনা নামকরণ !
এই রাজবাড়ির দালান থেকে প্রত্যেকটি ঘর, সব কিছুরই নিজস্বতা বর্তমান।
রাজবাড়ী পাঁচটি মহল্লায় বিভক্ত - একটি গ্রাম আদালতঘর, একটি ব্যালে নৃত্যকলা হল, রান্নাঘর ঘর, গেস্ট হাউস এবং মহিলাদের জন্য একটি অন্দর মহল।
আভিজাত্যপূর্ণ ছোঁয়া রেখে ঘরগুলির বিভিন্নরকম নামকরণ করা হয়েছে।
কক্ষগুলি সাধারণ বাঙালি যৌথ পরিবারের প্রধানের নামে নামকরণ করা হয়েছে।
" ঠাকুমার ঘর" , 'বড় বউদির 'ঘর নাম গুলো আপনাকে সেই সময়ের একান্নবর্তী পরিবারে ফিরিয়ে নেবে, যখন বাবা-মা বাদেও থাকতো বৃহত্তম পরিবারের আস্কারা এবং স্নেহ !
এখানে আপনি ডে আউট ট্রিপের জন্য "আনন্দ" সভাঘর পাবেন।
A+ শ্রেনিবিন্যাসে পাবেন "বড়ো বৌদি", "ছোটো বৌদি", "ঠাকুমা "; তেমনি "মা" ক্যাটাগরি তে পাবেন "গিন্নি মা", "বড়ো মা", "মেজো মা"।
হাতে টানা পাখা |
এছাড়াও মাটির কুঁড়েঘরের রসাস্বাদন করতে চাইলে "অপরাজিতা", "মাধবীলতা"ও আছে। এগুলো ছাড়াও বিভিন্ন মানের কক্ষ বাজেট অনুযায়ী বেছে নেওয়া যেতে পারে। ঘর গুলির পালঙ্ক থেকে হাতপাখা, জানলা-দরজার কারুকার্য সবই যেন ইতিহাসের প্রেক্ষিতে কথা বলছে। বিকেলে চারটের সময় স্থানীয় এক গাইড এই পুরো রাজবাড়িটি ঘুরিয়ে দেখান । তারপর চা-ঘরে চা খেয়ে সন্ধ্যা ছয়টায় রাধা-মাধবের মন্দিরে সন্ধ্যা আরতি!
সভাঘর |
রিক্রিয়েশন রুমে বইপ্রেমীর বইয়ের পাতার স্বাদ উপভোগ অথবা বাঙালি আড্ডার মন কে ক্যারম খেলেও আনন্দ দেওয়ার পাশাপাশি সন্ধ্যের পরশ মেখে এক স্থানীয় বাঁশি বাদকের সৃষ্ট সুরে হারিয়ে যাওয়া- সব গুলো অপশান হাতের সামনে। অথবা মৎস্য শিকারের অভিজ্ঞতায় সামিল হতে ছোট হাতছিপ নিয়ে বিশাল বাঁধানো পুকুর পাড়ে খানিক সময় অতিবাহিত করা। আর রাজবাড়ির সাথে জুড়ে আছে বেশ কিছু ভুতুড়ে গল্প । নর্তকীদের নূপুরের শব্দ অনেকেরই মেরুদণ্ডে শিহরণ জুগিয়েছে !
রাজবাড়ির অন্দরমহল |
বিশেষ দ্রষ্টব্য - এখানে দোলযাত্রার সময় সাধারণ মানুষের প্রবেশ বন্ধ থাকে এবং এদের বিভিন্ন মানের প্রি-ওয়েডিং প্যাকেজও বর্তমান।
যোগাযোগ -
9874537940
7003121811
ছবি ঋণ ও তথ্যাবলি-ঐশিকা দাস
Comments
Post a Comment