প্রাক বর্ষার 'বক্সা'
জঙ্গল-নদী-বৃষ্টি নিয়ে এক সাথে ভাবলেই মনটা কেমন দুম করে উত্তরবঙ্গগামী হয়ে ওঠে না?মনে হয় না,একবার ঐ নশ্বর শরীরটাকে প্রকৃতির গভীরতায় বেঁধে ফেলি?শুধু একটু টিকিট কাটার ঝক্কি,বাকিটা একটা ছোট্ট স্ক্রিনের উপর বুড়ো আঙুলের কারিকুরি। উত্তরবঙ্গ তো অনেকটা জায়গা, রাশি রাশি রসদ মজুত করা সেখানে। আজ তাহলে জঙ্গলের গালিচা পেরিয়ে, ইতিউতি প্রজাপতির পাখায় ভর করে এক চঞ্চলমতির ধারে গিয়ে বসা যাক। ওকে সবাই 'জয়ন্তী' নামেই চেনে, আর ওর জন্যই গ্রামটারও ঐ একই নাম।
উত্তরবঙ্গের প্রবেশপথ শিলিগুড়ি থেকে ১৭৫ কিলোমিটার দূরে বক্সা পাহাড়ের পাদদেশে ৭৬০.৮৭ বর্গ কিলোমিটারের সংরক্ষিত বনভূমির ২৬৯ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বক্সার এই অভয়ারণ্য। জয়ন্তী, নিমাটি , ভুটান ঘাট, রাজাভাতখাওয়া, বক্সাদুয়ার সহ আরো কিছু বনাঞ্চল নিয়ে গঠিত বক্সা, টাইগার রিজার্ভ হিসাবে ঘোষিত হয় ১৯৮৩ সাল থেকে। আলিপুরদুয়ার থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরে বক্সা জঙ্গলের ধারেই অবস্থিত 'ডুয়ার্সের রানী' জয়ন্তী। নদী সত্ত্বায় পরিপূর্ণ অপরূপ সৌন্দর্যমন্ডিত এই গ্রাম। তার এই রূপ দেখতেই তো বর্ষার শুরুতে ওর কাছে আসা। আপন মনে গ্রামীন প্রকৃতিতে যখন নিজেদের উজাড় করে দিচ্ছি, সামনেই দেখি সাদা কাজল পরে ছোট্ট একটা সজীবতার নড়নচড়ন, নুড়ির রঙে মিশে গিয়ে গুটি গুটি পায়ে খাবার খুঁজে চলেছে নিজের খেয়ালে। পিছনে দেখি ওই দলের আরো কয়েকজন। নামটা ওর পরে জেনেছিলাম - 'স্মল প্র্যাটিনকোল'। দু'একটা পাথরের চাঁই ডিঙিয়ে নদীটার মাঝে সবাই গিয়ে বসলাম, কি দারুণ একাকী ভাবে নুড়ি বালি ভেদ করে এক অপরূপ শিল্পীর ন্যায় চিত্রপটে সে নিজেকে পেশ করছে। আজ ধীরগতিতে পলি সরিয়ে মাঝখান থেকে কি যেন বলতে চাইছে ক্ষীন কন্ঠে। পাথুরে ভার বেড়ে যাওয়ায় এখন একটু আস্তেই কথা বলে, কিন্তু বর্ষার সোহাগ পেলে যেন গা থেকে লাস্য ঝরে পড়ে তার। জয়ন্তীকে আজ অনন্যা লাগছে বটে, আকাশের থেকে নীল রং বেছে বেছে পরেছে গায়ে, পাশ থেকে সবুজ বন্ধুরাও রং ছিটিয়ে ওকে অপরূপা করে তুলেছে বর্ষার ল্যান্ডস্কেপে। পাশেই একদল কাঁচা সবুজের কিচিরমিচির, গলায় তাদের আবিরসম আভা। ওমা! ওগুলো যে 'রোস রিং প্যারাকিট'। টিয়াগুলো সেই তখন থেকে ছটফটিয়ে শুধু গাছের এডাল ওডাল করে বেড়াচ্ছে। এখানে পাখির সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে প্রজাপতিদেরও আড্ডা। আপন মনে কেউ বসে আছে নুড়িগুলোর উপর, কেউ বা আবার বৃষ্টির জলে ভেজা পাখাটা মেলে শুকনো করে নিচ্ছে নিজেকে। পাশে উঁচু ঢিপির উপর বসে আছে কতগুলো 'কমন ম্যাপউইং', ঠিক যেন প্রকৃতি তার মানচিত্রটিকে একে রেখেছে তার পুরো শরীরে। রিভার বেডের সাথে সাথেই উড়ে বেড়াচ্ছে একদল 'পয়েন্টেট সিলিয়েট ব্লু'। দেহের পিছন দিকে ছোট্ট একটা লালের ছটা, কি সুন্দর শুঁড় তুলে রসাস্বাদন করছে নদী মায়ের কোল থেকে। ওপারের সাজানো বাড়িগুলোতে চলছে তাদের দিনলিপি মাফিক কর্মক্রিয়া। বাড়ির বাচ্চাটা লাঠির মিঠে কায়দায় পোষা পাখিগুলোকে বাড়ির সামনেই ছোটাছুটি করাচ্ছে, পাশের ঘরের মেয়েটি জঙ্গল থেকে কত শুকনো কাঠ নিয়ে এসেছে, এবার আবেগ জড়িয়ে সেগুলো মজুত করছে জীবনসংগ্রামের জন্য। হঠাৎ শুকনো ঝুরি জড়ানো গাছটার মাথায় বেগুনির ছটা দেখেই মনের ভিতরে স্রোত খেলে গেল। পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে এর আগেও এদের দেখেছি, কিন্তু এভাবে শান্ত পরিবেশে এত নিখাদ সুন্দরী অর্কিড যেন পায়েসের উপর কেশরের স্পর্শ। জয়ন্তী দেখছি এদের সবাইকে নিয়ে বেশ ভালোই আছে। কারুর কোনো তাড়া নেই এখানে, যেতে আসতে সবাই একবার করে কথা বলে যায় ওর সাথে। সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেয় তারা, এতেই ওর বেশ দিন চলে যায়। নীল রঙা ভুটানি পাহাড় গুলোও তো সারাদিন থাকে ওর সাথে, দূর থেকে কি সুন্দর চোখে চোখে কথা বলে ওরা, হাসিতে মাতিয়ে রাখে।
স্মল প্র্যাটিনকোল |
কমন ম্যাপউইং |
জয়ন্তী বাজার ছাড়িয়েই কিছুটা গেলে পুখরি লেক, পায়ে হেঁটেই জঙ্গলের নেশায় চলে যাওয়া যায় সেখানে। কত রকমের পাখি, প্রজাপতির মেলা; যা দেখলে দুনিয়ার সব মোহ ত্যাগ করে থেকে যেতে ইচ্ছা হয়। কোন মায়াজাল যেন সামনের অদৃশ্যকে আগে থেকেই বুঝে নেওয়ার সাহস জোগায়। সামনের বাঁকটা ঘুরতেই বেশ কিছু বাঁশ ঝাড়, কি যেন একটা নড়ছে না? হলুদ কালো শরীরে অত্ত বড়ো ঠোঁট নিয়ে একটা 'বড়ো পান্ছী' বসে আছে যে! এই প্রজাতিটি 'রুফাস নেক্ড হর্নবিল'-এর। নামটা একটু অচেনা লাগলো তো? একেই আমরা সাধারণত ধনেশ বলে চিনি। ভোরের বেলাতেই হঠাৎ চোখের সামনে এত নিঁখুত প্রাকৃতিক সৃষ্টি চাক্ষুষ করার সৌভাগ্য হওয়ায় মনটা হাওয়ায় দোল খাওয়া বাঁশ গাছের মতোই হয়ে উঠলো। বুকের ভিতর উথাল পাথাল নিয়ে মেঘের আবেশে এগিয়ে চললাম খাড়াই বেয়ে বেয়ে। রাস্তাটা এখানে সরু, তবে কিছুটা গিয়ে একটু ফাঁকা প্রশস্ত জায়গায় কতগুলো বৌদ্ধদের মন্ত্র লিখিত লাল-নীল-হলুদ পতাকা চোখে পড়লো। কোনো বীরত্বের কাহিনীর জয়ধ্বজার ন্যায় পতপত শব্দে খাদের ধারে সেগুলো নির্জন পরিবেশে আরও হাতছানি দিয়ে ডাকছিল। কথিত আছে এই মন্ত্রের রেশ হাওয়ার স্পর্শে মানবজীবনে শান্তি আনে। কতগুলো শক্ত গাছের শিকড় যুক্ত অপ্রশস্ত পাথুরে মাটির সিঁড়ি অতিক্রম করে উপরের দিকে উঠলাম। আগে উপরে ওঠার এই ছোটো সিঁড়িগুলি বাধাই করা ছিল, কিন্তু 'গজ'পালের উপরে ওঠার অসুবিধার কারণে বনদপ্তর ও গ্রামবাসীদের প্রচেষ্টায় সেইগুলি এখন শুধু নুড়ি-কাঁকরের খাড়াই ঢাল মাত্র। গাছের আড়ালে সূর্য রশ্মির সাথে জলের শান্ত স্রোতের দেখা পেলাম, হলুদাভ সবুজ জলের সাথে ভোরের আলোর আভার এক অদ্ভুত মোহময়ী মেলবন্ধন। এক বন্ধু কথা বলতে বলতেই ছুটে গেল জলাশয়টার দিকে। খাবারগুলো ফেলতেই প্রচুর মাগুর মাছ ঝড়ের বেগে সেগুলো খেতে এগিয়ে এলো, এদের ছাড়াও কতগুলো কাছিমের দেখা পেলাম। শোনা যায় এই মৎস্য প্রজাতি নাকি ভগবান বিষ্ণুর অবতার রূপে এখানে বিরাজমান। প্রচলিত তথ্য অনুযায়ী কোনো বৌদ্ধভিক্ষু এককালে এদের এই জলাশয়ে ভগবানের উদ্দেশ্যে অর্পণ করে এদের পূজো করা শুরু করেন, যারপর থেকেই লোকমুখে এই স্থানের সংরক্ষনের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। দীর্ঘদিন ধরে এই জলাশয়ই পাহাড়ের উপরের বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য বজায় রেখে বন্যপ্রানীদের জলের সমস্যাও মিটিয়ে আসছে। আশেপাশের গ্রামবাসীরা প্রায় প্রতি পূজো পার্বনেই এখানে আসেন নিজেদের মনস্কামনা পূরনের আশায়। পুরানকথা ও বন্যপ্রানের সমন্বয় চেখে নেওয়ার উদ্দেশ্যে এখানে ট্রেক করে হেঁটে আসাই সব থেকে ভালো অপশান।
চিরহরিৎ বনানীর মাঝে |
জটিল খাদ্যকে সরল করার প্রস্তুতি(জায়েন্ট উড স্পাইডার) |
খাবার মজুত করে রাখার প্রস্তুতি(জায়েন্ট উড স্পাইডার) |
'ব্ল্যাক ইউপটেরোটা টিসটাসিয়া' ক্যাটারপিলার |
আলিপুরদুয়ারের দিক থেকে এলে জয়ন্তীর রাস্তাকে ডান দিকে ফেলে, সোজা রাস্তা চলে যায় ছোট্ট গ্রাম
আঠাশ বস্তির দিকে। বৃষ্টির জোর বাড়ে মাঝে মাঝে, বস্তিতে সব নিঝুম। মাঠ সবুজ, ওই দূরে বক্সা পাহাড়; ঝাপসা নীল। এখানের সবুজ খেত আর দূর সীমানায় মেঘের আনাগোনা দেখতে দেখতেই অনেকক্ষন চোখকে আরাম দেওয়া যায়। ঐ রাস্তাতেই সুরক্ষা বাহিনীর ক্যাম্প ছাড়িয়ে এলেই শুরু হয় আঁকাবাঁকা চড়াই, খানিক এগিয়ে গেলেই সান্তালাবাড়ি। পাশেই দু’একটা দোকান রয়েছে , ঝাপগুলো বন্ধ। সামনে বক্সা ফোর্ট যাওয়ার রাস্তাটা এঁকেবেঁকে উঠে গেছে অসীমে, ইতিহাসকে চিনিয়ে দিতে সে যেন নিজেই আজ হাত ধরে নিয়ে যাবে উপরে। পাথর, সবুজ লতাপাতা, গাছগাছালি মিলেমিশে রাস্তাটাকে কেমন যেন রহস্যময়ী মনে হচ্ছে, অজানার মাঝে চলার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তিটুকু এখান থেকেই যেন দেহ মনে সঞ্চারিত হয়। বৃষ্টিটা ধরে এসেছে এতক্ষনে। ঘরে অতিথি এলে তাকে নিরাশ না করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ প্রকৃতির সাথে বাক্যালাপ করতে করতে মন যায় এগিয়ে। দূরে দেখা গেল এক শালিকের মতো পাখি, ওটা 'জাংগল ময়না'। সাথে ভিন দেশে নিজের পাড়ার ওরিওল, ট্রিপাই...এরা তো আছেই। এই আলাপচারিতা সারতে সারতেই চলে এলাম জিরো পয়েন্টে, এখান থেকে পথ আরও খাড়াই। বিশ্রাম নেওয়ার জন্য সামনেই একটু বসার জায়গায় পায়ের ক্লান্তি মুছিয়ে দিল সাথে থাকা মেঘের চাদর। একটু ঘুরতেই দেখি একরাশ নীলের রেশ যেন ঘন সবুজ থেকে উঁকি দিচ্ছে, কিছু বোঝার আগেই শান্তির পরিবেশ ভঙ্গ হল এক দারুণ তীব্র স্বরে। এ যেন কোনো পুরুষ সঙ্গীর সতর্কিকরন বার্তা। সে তার ময়ূরীকে আগে থেকেই জানিয়ে দিল আমাদের উপস্থিতি। তাদের রূপ, প্রত্যেকটি রঙের অপরূপ সংমিশ্রন যেন তুলির টানে হয়ে উঠেছে মোহময়ী। পেখম মেলে একজন এগিয়ে চলছে সামনের জঙ্গলের দিকে, অন্যজন আবার ডানা ঝাপটে উড়ে গিয়ে বসলো ঐ পাথরটার উপর। তারপর কিভাবে যেন অদৃশ্য হয়ে গেল ওই বনের মাঝে। এই ঘটনা অনেকক্ষন অভিভূত হয়েও চোখের খিদে মিটল
না। পুরো ঘটনাটা ক্যামেরাবন্দি করে আমরাও এগোতে লাগলাম আমাদের লক্ষ্য নিয়ে। ঝোরার জল সামনেই নিচে নেমে আসছে। পাথুরে পথটার উপর বসে আছে এক কাজলপাখি, চোখাচুখি হতেই মুখ ঘুরিয়ে নিজের মতো এদিক ওদিক দেখছে। রোজনামচায় সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ কি আর ওর মতো সবার হয়?। এসব অনাবিল আবেগ আর মনের ভাষা খুঁজতে খুঁজতে চলে এলাম এক ভিউ পয়েন্টের কাছে। একদম খাদের ধারেই, দূর নীলিমার মাঝে দেখা যাচ্ছে নদীর গতিপথ গুলো, ছাই ছাই পাহাড়ের মাঝে হারিয়ে গিয়েও ধরা দিচ্ছে অসমান ক্যানভাসে। তখনই মাথায় এল -আচ্ছা! স্কুলের ভূগোল বইয়ে কি এই ছবিটাই দেখেছিলাম? এরকমই তো আঁকা ছিল, কত কষ্ট করে তুলি দিয়ে রং গুলো মেলাতে হয়েছিল সেইসময়। কিন্তু আজ তো পুরোনো স্মৃতির পাতা থেকে অজান্তেই মিলে গেল অবিকল। মনে তখন দারুণ আনন্দ! ক্লান্তির বাঁধন ছাড়িয়ে চলেছি পাথর কাঁকরের সংকীর্ণতা ধরে। শান্তির পথ খুঁজে নিয়ে আস্তে আস্তে উপরে উঠতেই সামনে কিছু প্রশস্ত সবুজের পারেই দেখা যায় দূর্গের প্রিসনসেল গুলো, আজও যারা বিপ্লবীদের বন্দিদশার কাহিনীর অপারগ সাক্ষী। রেশম পথ কে রক্ষার স্বার্থে একদা ভুটানের রাজা এই দূর্গটি ব্যবহার করতেন। প্রায় ২৮৪৪ ফিট উচ্চতার এই অবস্থান থেকে ভারতের সাথে তিব্বতের সংযোগকারী এই পথ সুরক্ষার বিষয়টি দেখাশোনা করা ছিল অনেক সহজতর। ১৮৬৫ সালে ভুটান যুদ্ধের পর ব্রিটিশরা এই দূর্গ অধিকার করে নেয়। তারপর থেকেই অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামীদের এখানে নির্বাসিত করে রাখা হতো। ঘাসজমির পাশ থেকেই সোজা উঠে গেছে একটা সিঁড়ির বাঁক, যা নিরব ফোর্টের সামনে গিয়ে থমকে দেয় ইতিহাসকে। কান পাতলেই যেন প্রাগৈতিহাসিক কালের কত ঘটনার আঙ্গিক খুঁজে পাওয়া যায়, কত শব্দ যেন কানে ভেসে আসে, শুনিয়ে যায় কত অজানা তথ্য। ভিতরে ঢুকতেই সামনে চোখে পড়ে যায় ১৯৩১ সালে কবিগুরুর লেখা সেই চিঠির প্রস্তরিকরণ, যা তিনি রাজবন্দিদের উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছিলেন। দূর্গের বন্দীদের পক্ষ থেকে বিপ্লবী সাহিত্যিক অমলেন্দু দাশগুপ্ত রবীন্দ্রনাথ কে তাঁর ৭০ তম জন্মদিনের শুভেচ্ছা সহ যে অভিনন্দন পত্র পাঠান, এই চিঠি ছিল তারই প্রত্যুত্তর। জেলের বদ্ধ কুঠুরি গুলোতে ঢুকলেই প্রানের শিহরণ যেন পায়ের গতিকে শিথিল করে দেয়। মনে পড়ে যায় কত শহীদের প্রান বলিদানের কথা। তাদের আত্মত্যাগের দোসর হিসেবে পাথুরে দেওয়াল গুলোর চাপা কান্না মননে এক অসীম শ্রদ্ধাবোধের জন্ম দেয়। শুকনো গাছের গুড়িঁতে বসে সামনে দিগন্ত বিস্তৃত পাহাড়ি আবেগের দিকে তাকিয়ে থাকতেই সময় পার হয়ে যায়। না! আর বসে থাকলে চলবে না, এবার যে যেতে হবে পরের গন্তব্যের দিকে।
দূরে দেখা যায় দূর্গের প্রিসনসেল গুলো |
দূর্গের রাস্তায় দেখা পাওয়া পুরুষ ময়ূরটি |
নদী আর ইতিহাসকে পিছনে ফেলে এবার চলে এলাম বক্সার কোর সাফারিতে। ঝিঁঝিঁ পোকার আর্তনাদ ছাড়া আর কি কি দেখার সৌভাগ্য আছে তা একবার যাচাই করেই নেওয়া যাক। ছাব্বিশ মাইলের এই সাফারিতে অর্ন্তনিহিত থাকে বালা ও জয়ন্তি নদীর প্রানভোমরা। সকাল থেকে বনের বাসিন্দাদের কাহিনির সাক্ষী হতে থাকে তারা। বক্সা ফরেস্টের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত বালা নদী, তাকে ঘিরে উদ্ভূত গভীর ফরেস্ট, পাশাপাশি ছড়িয়ে থাকা গ্রামগুলির নিস্তব্ধতা, সুউচ্চ পাহাড়ের মৌনমুগ্ধতা মিলিয়ে শান্তিপ্রিয় এক স্বস্তির গন্তব্য রূপে ধরা দিল এই বক্সা। বর্ষার গন্ধ গায়ে মেখে বন্যতা এক আদিম চেতনায় অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য। পাতা থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছে, তার উপরেই অধীর আগ্রহে জাল বুনছে 'সিগনেচার স্পাইডার'। তার এই নিপুণ বুনন কৌশল দেখছি...ঠিক তখনই গাইড দেখালো দূরে শুকনো গাছের ডালে এক ফ্যালকন বসে, শিকারের তাগিদে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে নিচ্ছে ভালো করে। সাদা সাদা চোখের কাছটা চকচক করছে দূর থেকে। বৃষ্টির পরে বিকেলের হালকা তাপটা গায়ে মাখছি অনেকক্ষন ধরেই। পরিবেশটাকে ষোলো আনা নিংড়ে নিতে সামনের গাড়ির চাকার দাগ অনুসরণ করে আমরাও যাচ্ছি এগিয়ে। বন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে নয়ন ভোলানো এই পথ। যে দিকেই তাকাই স্নিগ্ধতা জড়ানো চোখের আরাম। গাছগুলোর দিকে তাকালেই আসামের ঘন চিরসবুজ বনের ছোঁয়া পাওয়া যায়, উপহিমালয়ের মিশ্র ভেজা বন ও পূর্বাঞ্চলীয় আধা সবুজ বনাঞ্চলেরও আভাস মেলে এখানে। সামনের পথটার মাঝে লেপার্ড দেখাও আশ্চর্যের কিছু নয়, কি জানি! হয়তো সে লুকিয়ে আমাদের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। শাল, সেগুন, শিমুল, চাঁপা বনের ফাঁকে কত্ত অচেনা পাখির ডাক। কিছু ডাকের সাথে তো আগেই এখানে এসে পরিচয় ঘটেছে। কোনটা এলার্ম কল, কোনটা বা কোর্টশিপের তাগিদে ডাক, একটু একটু করে বুঝতে পারছি এখন। মনের আনন্দে এরা খেলে চলেছে কেউ, কেউ ঘরে ফেরার আগে আজকের দিনের শেষ দানা পানিটি সংগ্রহ করতে ব্যস্ত, কেউ বা দূর থেকেই নিজের সঙ্গীকে উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। এই মরশুমে নদীর স্রোত টাও চোখে পড়ার মতো। এর পাশেই খানিক্ষন গাড়িটা অপেক্ষা করলো আমাদের। সন্ধ্যের আগে অনেক জীবজন্তু নদীর এপার ওপার করে, তাদের দর্শন পাওয়ার আশায় তাকিয়ে রইলাম সামনের দিকে। নদীর ধারেই একটা নতুন ওয়াচটাওয়ার তৈরি হচ্ছে বনদপ্তরের পক্ষ থেকে, কিছুদিনের ভিতর কাজ শেষও হয়ে যাবে হয়তো।বেশিক্ষন ধৈর্য্যের পরীক্ষা না নিয়েই নির্মিয়মান এই টাওয়ারের পাশ থেকে বেরিয়ে এল এক ময়ূরী, পিছনেই তার সঙ্গীটি। নদীর ধারে সান্ধ্যকালীন ভ্রমণটা সেরে নিচ্ছে তারা নিজেদের মতো করে। আমাদের সাথে বক্সার ইতিহাস শেয়ার করতে করতেই গাইডের চোখ চলে গেল এক 'ব্লু হুইসলিং থ্রাশের' দিকে। ঘন নীল রঙা চেহারা, গাছের ছায়ায় মিশে তাকে কুয়াশা মাখা রাত্রি বলে ঠাওর হচ্ছিল। সেও নিজের বাড়ি ফেরার তোড়জোড়ে ব্যস্ত এখন, বেশিক্ষন বসলোই না আমাদের সামনে। হঠাৎ কি মনে হলো, গাইডকে জিজ্ঞেস করেই বসলাম - “এতো পাখির নাম মনে রাখো কি করে?”। তারপরই জানতে পারলাম বক্সার বুকে আয়োজিত পাখি ও প্রজাপতি সমীক্ষার কথা। সেই সময় প্রত্যেক গাইডকে পাখি ও প্রজাপতি চেনানোর বিশেষ প্রশিক্ষনও দেওয়া হয়। পর্যটন সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে পাখিদের স্বর্গরাজ্যে আয়োজিত এই উদ্যোগ সত্যিই আসামান্য। হালকা ঠান্ডা, বিকেলের হাওয়ার ভিতর এ গাছ থেকে ও গাছে চরকি কাটছে এক দল লাল মিনিভেট। গাঢ় কমলা রঙটা বিকেলের ঘনায়মান কুয়াশার ব্যাকগ্রাউন্ডে আগুনের মতো মনে হচ্ছিল। মেঘলা আকাশের তলায় গাড়িটা থামলেই হঠাৎ শয়ে শয়ে প্রজাপতি চোখে পড়লো। এরকম তো শুধু ফোনের ওয়ালপেপারেই দেখেছি। 'কমন টিট', 'প্লাফি টিট', 'কমন ক্রুইসার' কি নেই সেখানে? নীল, সবুজ, বেগুনী, হলুদ, আসমানি তাদের পাখার আস্তরণ। একটা গাছের গুঁড়ির নীচে অজস্র উড়ে বেড়াচ্ছে দলে দলে, একদলের পাখার রং মাটির উপর থেকে খুব কষ্টে আলাদা করা যাচ্ছে। কিছু সদস্যের গায়ে আবার কাটা কাটা দাগ, কেউ আবার পুরো পাতার মতো। সবটাই সত্যি দিবাস্বপ্নের মতো লাগছিল, এভাবে জ্ঞানত হারিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা সত্যিই আমার জীবনে খুব কম আছে। খানিকক্ষন সেখানে থেকে জঙ্গলের আসন্ন অন্ধকারকে গায়ে মেখে ফিরে আসছি নিজেদের হোমস্টের দিকে। জিপসির অদূরেই কিছু গাছের ছেঁড়া ডাল-লতা-পাতা, এক্ষুনি হাতির পাল গেছে এই পথে। যাহ্! আমাদের আর দেখা হলো না। গাইড বললো এতক্ষনে অনেকটাই বনের পথ ধরে এগিয়ে গেছে তারা, তাই অগত্যা আর দাঁড়িয়ে লাভ নেই। একবার শুধু ওই পাকদন্ডী পথটার সামনে একটা বাইসনের দেখা পেলাম, দলের বাকি সদস্যগুলো মনে হয় ওর আগেই বাড়ি ফিরে গেছে। পাতার জল লেগে জামার কিছুটা ভিজে গেছিল, হালকা সন্ধ্যের ঠান্ডায় সেটার দিকে এবার খেয়াল হলো। পরিবেশটাই এখন জানান দিচ্ছে হোমস্টেতে ফিরে এক কাপ চা যেন না হলেই নয়। এই আমেজে বার্বিকিউটাও আজ বেশ জমে যাবে। ভাবতে ভাবতেই শেষ হয়ে হল আমাদের কোর সাফারির সফর। পাখি-প্রজাপতির জগৎ থেকে বিদায় নিলাম এবারের মতো। দূরে দেখা যাচ্ছে সবুজ-হলুদ চেকপোস্টটা, এবার আমাদেরও যে ঘরে ফেরার পালা।।
"শেষ ক'রে দিল পাখি গান গাওয়া,নদীর উপরে পড়ে এলো হাওয়া;
ও পারের তীর,ভাঙা মন্দির আঁধারে মগন রে।
আসিছে মধুর ঝিল্লিনূপুরে গোধূলিলগন রে।"
ব্লু হুইসলিং থ্রাশ |
স্কারলেট মিনিভেট |
কমন টিট |
সিগনেচার স্পাইডার |
ভ্রমন সংক্রান্ত তথ্যাবলিঃ শিয়ালদহ থেকে আলিপুরদুয়ার যাওয়ার সবচেয়ে ভালো ট্রেন ১৩১৪৯
কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস। ট্রেনটি শিয়ালদা থেকে রাত ৮ টা ৩০ মিনিটে ছেড়ে আলিপুরদুয়ার পৌঁছায় পরদিন বেলা ১২ টা ১০ মিনিটে। এছাড়া হাওড়া থেকে আলিপুরদুয়ার যাওয়ার সুবিধাজনক ট্রেনটি হল সরাইঘাট এক্সপ্রেস, এটি রোজ হাওড়া থেকে ছাড়ে বিকেল ৩টে বেজে ৫০ মিনিটে আর নিউ আলিপুরদুয়ার পৌঁছায় পরদিন ভোরবেলা ৪ টে ৩৫ মিনিটে। হাওড়া থেকে অন্যান্য ট্রেনগুলি হলো ১৫৬১১ কর্মভূমি এক্সপ্রেস (বৃহস্পতি), এবং ১৫৯০১ ডিব্রুগড় এক্সপ্রেস (বুধবার)। নিউ আলিপুরদুয়ার থেকে অটো রিজার্ভ করে জয়ন্তী আসা যায়। ভাড়া পড়ে ৩০০ – ৪০০ টাকা। এছাড়া হোমস্টে গুলিতে আগে থেকে বলে রাখলে তারা গাড়ির ব্যবস্থা করে দেয়। এছাড়া প্রতিদিন একটি বাস আলিপুরদুয়ার থেকে জয়ন্তী যায় ও জয়ন্তী থেকে আলিপুরদুয়ার আসে।
বক্সা টাইগার রিজার্ভে ঢোকার সময় রাজাভাতখাওয়া গেটে মাথা পিছু চার্জ ৬০ টাকা ও গাড়ির এন্ট্রি
ফি বাবদ ২৫০ টাকা প্রথমেই কেটে নেওয়া হয়। যেটার সময়সীমা তিন দিন পর্যন্ত থাকে, পরে তা চাইলে অবশ্যই বাড়িয়ে নেওয়া যায়। বক্সা কোর সাফারিটি জয়ন্তি থেকেই বুক করতে হয়। পিক সিজনে তাই কোর সাফারি পাওয়া একটু চাপেরই হয়। এছাড়াও বড়ো মহাকাল, ছোটো মহাকাল, চুনিয়া ও পুকরি লেকের সাফারি করা যায়। মহাকাল ছাড়া বাকি সাফারিগুলির জন্য কম বেশি দেড় ঘন্টা সময় বরাদ্দ থাকে। মহাকালের জন্য যাওয়া আসা মিলিয়ে চার ঘন্টা সময় লেগেই যায়। সাফারি সকাল সন্ধ্যে দুই বেলা হয়। সকালের টাইমিং (৬ টা থেকে ৮ টা), বিকেলের টাইমিং (৩ টে থেকে ৫ টা)। পুখরির জন্য গাড়ি ৫০০ টাকা, চুনিয়ার জন্য ৭০০ টাকা ও মহাকালের জন্য ৮০০ টাকা ধার্য করা হয়। মহাকালের ক্ষেত্রে গাইড চার্জ ৩০০ টাকা, বাকি ক্ষেত্রে ২৫০ টাকা করে। গাইড সব ক্ষেত্রেই বাধ্যতামূলক।
থাকার জায়গা হিসাবে সান্তালাবাড়ির বনপাহাড়ি রিসর্ট (9230023400 / 8597930633),আরণ্যক
হলিডেস্ (7998495918) এর অবস্থান অসাধারণ। এছাড়া জয়ন্তীতে নদীর ধারেই একটি দুটি ভালো হোমস্টে পাবেন। রুম,গাড়ি, সাফারির জন্য যোগাযোগ - রামচন্দ্র শাহ (9593828226) ;যিনি একাধারে বক্সার দক্ষ গাইডরূপেও নিযুক্ত আছেন এবং এনার এখানে নিজস্ব হোটেলও আছে।বক্সার সাফারি ১৫ জুলাই থেকে ১৫সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অতিরিক্ত বর্ষার কারণে বন্ধ থাকে,এছাড়া বছরের অন্য সময় সাফারির জন্য কমপক্ষে এক মাস আগে বুকিং করতে হয়।
তথ্যাবলি ও চিত্র সৌজন্যে- বন্যপ্রানপ্রেমী ফটোগ্রাফার অর্পন সেনগুপ্ত
Just awesome....
ReplyDeleteLoved it very much ❤❤❤❤