১৯৫২ ভাষা আন্দোলনের পটভূমি
১৯৫২ বাংলা ভাষা আন্দোলনের পটভূমি
ভূমিকা ঃ-
ভাষাগত দিক থেকে আমরা বাঙালি যেহেতু আমাদের মাতৃভাষা 'বাংলা' আর এই ভাষার জন্যই বুকের তাজা রক্ত ঝড়েছে যাঁদের, তাদের প্রতি আমরা চিরকৃতজ্ঞ। তবে প্রত্যেক ঘটনার পিছনেই কারণ থাকে-১৯৫২সনের একুশে ফেব্রুয়ারি হঠাৎ করে আসেনি।
ধর্মের চেয়ে যে ভাষার বন্ধন অনেক অনেক শক্তিশালী মহান একুশ তাহা আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছে।
দ্বিজাতিতত্ত্ব ঃ-
মুসলিম লীগ ভেবেছিল দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টি হলে"আমাদের ইচ্ছে মত দেশ চলাতে পারবো।" ওদের ধারনা ছিলো বাংলা হলো হিন্দু সংস্কৃতি প্রভাবিত জাতি সত্বা। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য যে, তখন বাঙালি মুসলমানদের শিক্ষিত শ্রেণির একাংশ বিশেষ করে অভিজাত ও বিত্তবান শ্রেণির অংশ বাংলাকে মাতৃভূমি ও বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষা হিসেবে গ্রহণ করতে চায়নি। তারা নিজেদের ভেবেছেন আরব-তুরস্ক-পারস্য থেকে আগতদের উত্তর পুরুষ এবং মধ্যপ্রাচ্যের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে বাংলা ভাষার বদলে আরবি, উর্দু, ফারসিকে নিকটতর মনে করেছেন। এ প্রবনতাই বিশ শতকে এসে উর্দুকে মাতৃভাষা হিসেবে বিবেচনা করতে চেয়েছেন।
বাঙালি সত্বার বিকাশ ঃ-
এ-দ্বন্দের প্রথম প্রকাশ মধ্যযুগের মুসলমান কবিদের রচনায় ছিলো। প্রসঙ্গত আব্দুল হাকিমের কবিতা যেমন ছিলো "যে জন বঙ্গেতে জন্মে হিংসে বঙ্গ বাণী-------" উল্লেখ্য। তেমনি বিশ শতকেও মধ্যবিত্ত বাঙালি শিক্ষিত মুসলমানদের গরিষ্ঠ অংশ বাঙলা ভাষাকে মাতৃভাষা হিসেবে বিবেচনা করছে,বাঙালি জাতিসত্বার ভিত্তিতে। ভাষাগত স্বাতন্ত্র্য চেতনা বাঙালি সমাজে আগে থেকেই ছিলো এবং ১৯৪৭সালের লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন পরিকল্পনা ঘোষণার অব্যবহিত পরেই তার প্রকাশ ঘটেছিলো। মাউন্ট ব্যটেন ঘোষণার পরে পরেই আসন্ন পাকিস্তানের বিভিন্ন সমস্যা ও তাদের দৈনন্দিন উত্তেজনাময় আলোচনার বিষয় বস্তুর প্রধান বিষয় ছিলো রাষ্ট্র ভাষার প্রশ্নঃ কেননা ইতিমধ্যেই প্রচারিত হয়ে গিয়েছিল 'উর্দুকে'পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার চেষ্টা চলছে। সচেতন লেখকবৃন্দ তখনই এ প্রয়াসের বিরোধিতা করে এবং বাংলার দাবি প্রতিষ্ঠিত করার সংকল্প নিয়েছিলেন। বাঙালি বুদ্ধিজীবী সমাজ অনুমান করতে পেরেছিলেন যে 'উর্দুকেই' পাকিস্তানের রাস্ট্র ভাষা করার চেষ্টা করা হবে। কিন্তু সেটা হবে অসঙ্গত।
বাঙালিরা সংখ্যা গরিষ্ঠ ঃ-
পূর্ব পাকিস্তানের লোকসংখ্যা তখন ছিলো পাঁচ কোটির কিছু বেশি প্রায় সবাই বাংলা ভাষী,পশ্চিম পাকিস্তানের লোকসংখ্যা ছিলো তিন কোটির কাছাকাছি এবং ভাষা হিসাবে এই তিন কোটি লোকের ভাষা চারভাগে বিভক্ত ছিলো। ১৯৫১ সনের আদমশুমারীতে পাকিস্তানের বিভিন্ন ভাষাভাষী মানবগোষ্ঠীর আনুপাতিক হার ছিলো ঃ-
(১) বাঙালি ---৫৪.৬%
(২)পাঞ্জাবি ---২৮.৪%
(৩)উর্দুভাষী---৭.২%
(৪)পশতু------৭.১%
(৫)সিন্ধী -------৫.৮%
(৬)ইংরেজী -----১.৮% --------------------------------
মোট ১০৪. ৯(কেননা কিছু লোক একাধিক ভাষায় কথা বলতেন) পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাঙালির সংখ্যা গরিষ্ঠতা ছিলো প্রশ্নাতিত।
কিন্তু উর্দু পাকিস্তানের বিশেষ অঞ্চলের ভাষা ছিলোনা এবং পাকিস্তানের নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষাগুলোর মধ্যে বাংলা ভাষাই ছিলো সর্বাপেক্ষা উন্নত। এই সবই ছিলো বাংলা ভাষার স্বপক্ষে বড় যুক্তি। ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত কারণঃ- পাকিস্তান সরকার কোন যুক্তিই মানতে রাজি নয়। পাকিস্তান সৃষ্টির পরেই পূর্ব -পাকিস্তানের প্রশাসন যন্ত্রসহ বিভিন্ন চাকুরির ক্ষেত্রে উর্দুভাষীসহ(বাঙালি ছাড়া) অন্যান্য পাকিস্তানিদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ভাষাগত সংঘাতের এটাই ছিলো প্রত্যক্ষ ও মূল কারণ। হিন্দু-মুসলমানের অনেক বিষয়ে ঐক্য না থাকলেও উভয়েরই ভাষা ছিলো এক, সেদিক থেকে মনের যোগাযোগের পথ ছিলো উন্মুক্ত ; কিন্তু পাকিস্তানের অবাঙালিদের সাথে অনুরূপ ভাষার বন্ধন অনুপস্থিত, তার উপর উর্দু রাষ্ট্র ভাষা হলে পূর্ব -পাকিস্তানের সাহিত্য ও সংস্কৃতি উপেক্ষিত হবে এটাই ছিলো অনিবার্য। উর্দু রাষ্ট্র ভাষা হলে চাকুরির ক্ষেত্রে বাঙালির প্রতি অবিচার হবে এ সম্বন্ধে বাঙালির মনে কোনো সন্দেহ ছিলো না। উর্দু জানার ফলে অবাঙালিরা আগে থেকেই এগিয়ে আছে,অতএব সরকারি চাকুরিতে তারাই সর্বদা প্রধান্য পাবে এবং বাঙালিরা বঞ্চিত হবে এটাই স্বাভাবিক। উর্দু রাষ্ট্র ভাষা হলে বাঙালিরা পূর্ণ স্বাধীনতা পাবেনা,বদ্ধমুখ অবস্থায় স্বাধীনতা পাবে এবং বাঙালির স্বতন্ত্র স্বত্ত্বাই বিপন্ন হবে। উর্দু ভিন্ন জনগোষ্ঠীর ভাষা, এভাষা পূর্ব -পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হলে এদেশ হবে উর্দু ভাষীদের শাসন ও শোষণের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র এবং জাতি হিসাবে পূর্ব -পাকিস্তানের বাঙালির অস্তিত্ব বিলুপ্তি নিশ্চিত হবে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরেই-কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক প্রকাশিত এনভেলপ, পোস্টকার্ড,ডাকটিকেট, মানিঅর্ডার ফর্ম ইত্যাদিতে ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলার অনুপস্থিতি ছাত্রযুবা ও সরকারি কর্মীদের ক্ষুব্ধ করে তোলে। কারণ রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহার যোগ্য কাগজপত্রে বাংলা ভাষার অনুপস্থিতির অর্থ,বাঙালিদের কোনঠাসা করে উর্দু শিখতে বাধ্যকরা। সরকারের উদ্দেশ্য বুঝতে সচেতন বাঙালিরা ভুল হয়নি। এভাবেই ভাষা চেতনার সাথে রাজনৈতিক চেতনার সমন্বয় ঘটে। বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে ভুল করেছিলো সরকার ও শাসক গোষ্ঠী। তাদের ধারণা ছিলো ধর্মীয় ঐক্যের দোহাই দিয়ে পূর্ব -পশ্চিমের অসমতা বা বৈষম্য ঢেকে দিতে পারবে। ওরা ভুল বুঝেছিলো বাঙালির আত্মপ্রতিষ্ঠার আকাঙ্খাকে। ইহাই ছিলো প্রধানত ঃ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মূল কারণ।
ভাষা আন্দোলন দুই পর্যায় বিভক্ত ছিলো ঃ
প্রথম পর্যায়ঃ-
১৯৪৮ সনের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে পরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত পরিষদের ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে ইংরেজি ও উর্দুর সঙ্গে বাংলাও অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব উত্থাপন করার পর প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান অশোভন ভাষায় তাহা প্রত্যাখ্যান করেন। তার ভাষায় সুস্পষ্টভাবে সাম্প্রদায়িক সুর ধ্বনিত হয়। পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন থেকে তমিজউদ্দিন খান মুসলিম লীগ সদস্য সবাই লিয়াকত আলী খানের বক্তব্যই সমর্থন করেন। প্রস্তাবটির সেখানেই অপমৃত্যু ঘটে। গণপরিষদের ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রত্যাখ্যান করায়-ঢাকায় ছাত্র যুবসমাজে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এর ফলে ২৬ ফেব্রুয়ারি -ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয় এবং মিছিল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্র সভায় সমবেত হন এবং গণপরিষদের সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা করে প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং সরকারের ভাষানীতির বিরুদ্ধে প্রদেশব্যাপী প্রতিবাদ সভা,হরতাল ও মিছিল সংঘটনের আহ্বান জানানো হয়। এরফলে বিভিন্ন সংঘটনের যুক্ত ভাষা কমিটিতে-পাকিস্তানি শাসকশ্রেণি ও গণপরিষদের ভাষা-বিষায়ক ভূমিকার প্রতিবাদে ১১ মার্চ সারা পূর্ব --পাকিস্তানে ধর্মঘট সহ সভা সমাবেশ পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। জনগনের ব্যাপক সমর্থনে বিশাল আন্দোলনে রূপনেয়।
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এর ঢাকা সফরঃ-
এরপর পাকিস্তানের স্থপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর পূর্ব -পাকিস্তান সফর। তিনি ২১ মার্চ ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানের বিশাল জনসভায়, ২৪ মার্চ কার্জনহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়লেয় বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করেণ যে" উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা, অন্যকোনো ভাষা নয়"। এই কথা বলার সাথে সাথেই এর বিরুদ্ধে একমাত্র কার্জনহলেই কয়েকজন প্রতিবাদী ছাত্রের কণ্ঠে 'নো-নো ' ধ্বনি উচ্চস্বরে উচ্চারিত হতে থাকে।
দ্বিতীয় পর্যায়ের ভাষা আন্দোলন ঃ-
পরবর্তী বছর গুলো (১৯৪৮থেকে ১৯৫১) চূড়ান্ত ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতি পর্ব হিসেবে বিবেচ্য। বাংলা কে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবীতে ১৯৪৮ সনে সূচিত ভাষা-আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপনেয় ১৯৫২ সনের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। ১৯৪৮ এর ১১ মার্চের আন্দোলনের সফলতার পরে জনগণ আরো কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণার জন্য নেতৃত্বের উপর চাপ দিতে থাকে। কিন্তু পাকিস্তান অর্জনের সাফল্যে সন্তুষ্ট ও গর্বিত এই নেতৃত্ব,পাকিস্তানের ভবিষ্যতের চিন্তায় বিভ্রান্ত ও শঙ্কিত হয়ে যে সব পদক্ষেপ গ্রহণ করলো-তাহাতে ভবিষ্যৎ আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটার উপক্রম হলো। এর পরে ১৯৫০সনে আব্দুল মতিন কে আহ্বায়ক করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে" রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ" গঠিত হয়। নূতন কমিটির নেতৃত্বে রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৫১ সনের ১১ এপ্রিল স্বাক্ষরিত এক স্মারক লিপি পাকিস্তান গণপরিষদে প্রেরণ করায় নূতন ভাবে আন্দোলন উজ্জীবিত হয়। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো-কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে "আরবি " হরফে বাংলা লেখার "হরফ ষড়যন্ত্র "।
একই সময়ে উর্দুবাদী বুদ্ধিজীবীদের বক্তৃতা, বিবৃতি ও লেখায় মূল বক্তব্য ছিল -" উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাস্ট্রভাষা"। এর জোরালো প্রতিবাদ হতে থাকে মাতৃভাষা আন্দোলনের পক্ষের ছাত্র -জনতা থেকে। আবার একই সময়ে খাদ্য-সংকট, লবন-সংকট, পাটের মূল্য মন্দা ইত্যাদি কারণে সংখ্যা গরিষ্ঠ জনতা সরকার বিরোধী হয়ে উঠে। এই পটভূমিতে ভাষা আন্দোলনের জন্য দরকার ছিলো একটি মাত্র স্ফুলিঙ্গের। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন সেই স্ফূলিঙ্গ পাতের কজটি সম্পন্ন করেন ২৭ জানুয়ারি ১৯৫২ এর বক্তৃতায়। তিনি বলেন " আমরা এসলামী রাষ্ট্র গঠন করতে যাচ্ছি, প্রদেশিকতা যে বা যারা প্রশ্রয়দেয় তারা পাকিস্তানের দুশমন"। তিনি আরও বলেন" প্রদেশিক ভাষা কি হবে তাহা স্থির করবে প্রদেশবাসী,কিন্তু পাকিস্তানের রাস্ট্র ভাষা হবে উর্দু। একাধিক রাষ্ট্র ভাষা থাকলে কোনো রাষ্ট্র শক্তিশালীহতে পারে না"। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ অনুষ্ঠিত ছাত্র সভায় ঘোষণা করা হয় যে আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি সারা দেশব্যাপী হরতাল, সভা-সমাবেশ-মিছিলের কর্মসূচি। ইতিমধ্যে সরকারি প্রশাসন থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরে এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হয় এবং বলা হয় "কোন সভা-সমাবেশ ঘেরাও -মিছিল চলবে না "। ছাত্র - যুব সমাজ এর তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় এবং বলতে থাকে " ১৪৪ ধারা মানছি না মানবো না"। একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বিখ্যাত 'আমতলায়' অনুষ্ঠিত ছাত্র সভায় "বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদের" পক্ষ থেকে আবদুল মতিন১৪৪ ধারা ভাঙ্গার কথা ঘোষনা করার সাথে সাথে উপস্থিত সকল ছাত্র-জনতাই মুহুর্মুহুঃ হাততালি দিয়ে তাকে সমর্থন করেন। সভাপতি গাজীউল হক ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত জানিয়ে সভার সমাপ্তি ঘোষণা করেন। সেখানে সবাই ১০ জনের এক একটি ছোটো ছোটো মিছিল নিয়ে,১৪৪ ধারা ভাঙ্গার প্রস্তাবে সম্মতি জানায়। শুরু হল ১০ জনের মিছিল নিয়ে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পালা। ওদিকে বাইরে রাস্তায় সশস্ত্র পুলিশ গ্রেফতার, লাঠিচার্জ ও কাঁদানো গ্যাস ছুড়ে ছাত্র -জনতা সমাবেশকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। তা সত্বেও ছাত্র -জনতা পুনরায় সমবেত হয় মেডিকেল হোষ্টেল প্রাঙ্গণে। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো পরিষদ ভবনের সামনে পৌঁছানো এবং পরিষদ সদস্যদের রাষ্ট্র ভাষা বাংলার পক্ষে প্রস্তাব গ্রহণের জন্য সম্মত করানো। আর পুলিশের উদ্দেশ্য ছিলো ছাত্র -জনতাকে, পরিষদ ভবনের সামনে যেতে না দেয়া। পুলিশের ক্রমাগত লাঠিচার্য,কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে,আর ছাত্র-জনতা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। শেষ পর্যন্ত দুপুর ৩ টার পর পুলিশ কোনো হুঁশিয়ারি ছাড়াই ছাত্র-জনতা উপরে পুলিশ গুলি বর্ষন করে। নির্বিচারে গুলি বর্ষনের ফলেঃ- রফিক-সালাম-বরকত-জব্বার এর মৃত্যু হয়।
গুলিতে নিহতদের সম্পর্কে কিছু তথ্য ঃ
(১) রফিক ঃ
মানিকগঞ্জের ছেলে রফিক উদ্দিন আহমেদের জন্ম-৩০ অক্টোবর ১৯২৬ মাতৃভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ। ১৯৫২ সনের ২১ ফেব্রুয়ারি গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনা স্থলেই শহীদ হন। এই সময় রফিক ঢাকা জগন্নাথ কলেজের ছাত্র ছিলেন।
(২)সালামঃ
ফেনীর, দাগনভূঞা গ্রামের ছেলে আবদুস সালামের জন্ম-২৭ নভেম্বর ১৯২৫। তিনি ১৯৫২ সনের২১ফেব্রুয়ারি গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জালড়ে শেষ পর্যন্ত ৭ এপ্রিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শহীদী মৃত্যু বরন করেন। তিনি পেশায় চাকুরিজীবী ছিলেন।
(৩) বরকতঃ
মুর্শিদাবাদের,বাবলা গ্রামের ছেলে আবুল বরকতের জন্ম-১৩ জুন ১৯২৭। ১৯৫২সনের ২১ ফেব্রুয়ারি গুলিবিদ্ধ হয়ে ঐ দিন রাত্র ৮ টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয়। মাতৃভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ.ক্লাসের ছাত্র ছিলেন।
৪) জব্বার ঃ
ময়মনসিংহের, পাঁচুয়া গ্রামের ছেলে আবদুল জব্বারের জন্ম-১০ অক্টোবর ১৯১৯। ১৯৫২ সনের ২১ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের মিছিলে যোগ দেয়ার ফলে গুলিবিদ্ধ হন ঐ দিন গভীর রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যু হয়। তিনি পেশায় চাকুরিজীবী ছিলেন।
আরও কত নাম না জানা ব্যাক্তির রক্তে রঞ্জিত হয়েছে একুশ তার হিসেব কি ইতিহাসে লেখা থাকবে?
গুলির পরবর্তী ঘটনা সমূহের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা ঃ-
মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ মেডিকেল কলেজ ছাত্রদের স্থাপিত কন্ট্রোল রুম থেকে মাইকে এই ঘটনা প্রচার করতে থাকেন। সিদ্ধান্ত থাকা সত্বেও শহীদের লাশ নিয়ে মিছিল করা যায়নি। পুলিশ মাঝ রাতেই হাসপাতাল থেকে লাশ তুলে আজিমপুর গোরস্থানে দাফন করে। তাই ২২ ফেব্রুয়ারি ছাত্র -জনতা মিছিল করে ঢাকার রাজপথ প্রদক্ষিণ করে এবং বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ তুলে"রাষ্ট্র ভাষা বাঙলা চাই ",রাজ বন্দীদের মুক্তি চাই ", " খুনি নুরুল আমিনের ফাঁসি চাই", " শহীদ স্মৃতি অমর হোক " ইত্যাদি। ২৩ ফেব্রুয়ারি মেডিকেল ছাত্ররা তাদের হোষ্টেল প্রাঙ্গণে একরাতে ১০'×৬' শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করে। ২৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশ স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙ্গে ফেলে এবং ইটের শেষ টুকরো টিও তুলে নিয়ে যায়। এই দিন থেকেই সরকারি দমননীতি প্রচণ্ড রূপ নেয়, ২৭ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধ ঘোষণা করা হয় এবং হোষ্টেল ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। ১৯৫৩ সনের২১ ফেব্রুয়ারি থেকে বিপুল সমারোহে প্রভাতফেরী,শহীদ মিনারে পুস্পাঞ্জলির মাধ্যমে শহীদ দিবস পালন করা হয়। আবদুল গফফার চৌধুরীর কবিতা -আলতাফ মাহমুদের সুরে একুশের গান, শহীদ দিবসের গান হিসেবে প্রচলিত হয়;
"
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতেপারি
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু গড়া এ ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি---
"
উপসংহার ঃ-
ভাষা আন্দোলনই প্রথম দ্বিজাতিতত্ত্ব ভিত্তির মূলে কুঠারাঘাত করে। পাকিস্তানের দুই প্রদেশের মধ্যে দূর ত্ব হাজার মাইলের উপর, আবার ভাষা গত পার্থক্য প্রচুর এভাবে শুধু মাত্র এক ধর্মের লোক হওয়ার কারণে কোনো রাষ্ট্র গঠন অবাস্তব কল্পনা মাত্র। ১৯৫২ সনে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে রোপিত বীজই ১৯৭১এ পরিপূর্ণ বৃক্ষের রূপনেয়, তারই ফলশ্রুতি হলো স্বাধীন বাংলাদেশ।
অনিল দাস।
প্রথম নির্মিত শহীদ মিনার |
শহীদ আব্দুস সালাম |
ভাষা শহীদ আবুল বরকত |
ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বার |
ভাষা শহীদ শফিউর রহমান |
কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি.........
ওরা চল্লিশজন কিংবা আরো বেশি
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে—রমনার রৌদ্রদগ্ধ কৃষ্ণচূড়ার গাছের তলায়
ভাষার জন্য, মাতৃভাষার জন্য—বাংলার জন্য।
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে
একটি দেশের মহান সংস্কৃতির মর্যাদার জন্য
আলাওলের ঐতিহ্য
কায়কোবাদ, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের
সাহিত্য ও কবিতার জন্য
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে
পলাশপুরের মকবুল আহমদের
পুঁথির জন্য
রমেশ শীলের গাথার জন্য,
জসীমউদ্দীনের ‘সোজন বাদিয়ার ঘাটের’ জন্য।
যারা প্রাণ দিয়েছে
ভাটিয়ালি, বাউল, কীর্তন, গজল
নজরুলের “খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি
আমার দেশের মাটি।”
এ দুটি লাইনের জন্য
দেশের মাটির জন্য,
রমনার মাঠের সেই মাটিতে
কৃষ্ণচূড়ার অসংখ্য ঝরা পাপড়ির মতো
চল্লিশটি তাজা প্রাণ আর
অঙ্কুরিত বীজের খোসার মধ্যে
আমি দেখতে পাচ্ছি তাদের অসংখ্য বুকের রক্ত।
রামেশ্বর, আবদুস সালামের কচি বুকের রক্ত
বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে সেরা কোনো ছেলের বুকের রক্ত।
আমি দেখতে পাচ্ছি তাদের প্রতিটি রক্তকণা
রমনার সবুজ ঘাসের উপর
আগুনের মতো জ্বলছে, জ্বলছে আর জ্বলছে।
এক একটি হীরের টুকরোর মতো
বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছেলে চল্লিশটি রত্ন
বেঁচে থাকলে যারা হতো
পাকিস্তানের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ
যাদের মধ্যে লিংকন, রকফেলার,
আরাগঁ, আইনস্টাইন আশ্রয় পেয়েছিল
যাদের মধ্যে আশ্রয় পেয়েছিল
শতাব্দীর সভ্যতার
সবচেয়ে প্রগতিশীল কয়েকটি মতবাদ,
সেই চল্লিশটি রত্ন যেখানে প্রাণ দিয়েছে
আমরা সেখানে কাঁদতে আসিনি।
যারা গুলি ভরতি রাইফেল নিয়ে এসেছিল ওখানে
যারা এসেছিল নির্দয়ভাবে হত্যা করার আদেশ নিয়ে
আমরা তাদের কাছে
ভাষার জন্য আবেদন জানাতেও আসিনি আজ।
আমরা এসেছি খুনি জালিমের ফাঁসির দাবি নিয়ে।
আমরা জানি ওদের হত্যা করা হয়েছে
নির্দয়ভাবে ওদের গুলি করা হয়েছে
ওদের কারো নাম তোমারই মতো ওসমান
কারো বাবা তোমারই বাবার মতো
হয়তো কেরানি, কিংবা পূর্ব বাংলার
নিভৃত কোনো গাঁয়ে কারো বাবা
মাটির বুক থেকে সোনা ফলায়
হয়তো কারো বাবা কোনো
সরকারি চাকুরে।
তোমারই আমারই মতো
যারা হয়তো আজকেও বেঁচে থাকতে
পারতো,
আমারই মতো তাদের কোনো একজনের
হয়তো বিয়ের দিনটি পর্যন্ত ধার্য হয়ে গিয়েছিল,
তোমারই মতো তাদের কোনো একজন হয়তো
মায়ের সদ্যপ্রাপ্ত চিঠিখানা এসে পড়বার আশায়
টেবিলে রেখে মিছিলে যোগ দিতে গিয়েছিল।
এমন এক একটি মূর্তিমান স্বপ্নকে বুকে চেপে
জালিমের গুলিতে যারা প্রাণ দিল
সেই সব মৃতদের নামে
আমি ফাঁসি দাবি করছি।
যারা আমার মাতৃভাষাকে নির্বাসন দিতে চেয়েছে তাদের জন্যে
আমি ফাঁসি দাবি করছি
যাদের আদেশে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে তাদের জন্যে
ফাঁসি দাবি করছি
যারা এই মৃতদেহের উপর দিয়ে
ক্ষমতার আসনে আরোহণ করেছে
সেই বিশ্বাসঘাতকদের জন্যে।
আমি তাদের বিচার দেখতে চাই।
খোলা ময়দানে সেই নির্দিষ্ট জায়গাতে
শাস্তিপ্রাপ্তদের গুলিবিদ্ধ অবস্থায়
আমার দেশের মানুষ দেখতে চায়।
পাকিস্তানের প্রথম শহীদ
এই চল্লিশটি রত্ন,
দেশের চল্লিশ জন সেরা ছেলে
মা, বাবা, নতুন বৌ, আর ছেলে মেয়ে নিয়ে
এই পৃথিবীর কোলে এক একটি
সংসার গড়ে তোলা যাদের
স্বপ্ন ছিল
যাদের স্বপ্ন ছিল আইনস্টাইনের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে
আরো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করার,
যাদের স্বপ্ন ছিল আণবিক শক্তিকে
কী ভাবে মানুষের কাজে লাগানো যায়
তার সাধনা করার,
যাদের স্বপ্ন ছিল রবীন্দ্রনাথের
‘বাঁশিওয়ালার’ চেয়েও সুন্দর
একটি কবিতা রচনা করার,
সেই সব শহীদ ভাইয়েরা আমার
যেখানে তোমরা প্রাণ দিয়েছ
সেখানে হাজার বছর পরেও
সেই মাটি থেকে তোমাদের রক্তাক্ত চিহ্ন
মুছে দিতে পারবে না সভ্যতার কোনো পদক্ষেপ।
যদিও অগণন অস্পষ্ট স্বর নিস্তব্ধতাকে ভঙ্গ করবে
তবুও বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ঘণ্টা ধ্বনি
প্রতিদিন তোমাদের ঐতিহাসিক মৃত্যুক্ষণ
ঘোষণা করবে।
যদিও ঝঞ্ঝা-বৃষ্টিপাতে—বিশ্ববিদ্যালয়ের
ভিত্তি পর্যন্ত নাড়িয়ে দিতে পারে
তবু তোমাদের শহীদ নামের ঔজ্জ্বল্য
কিছুতেই মুছে যাবে না।
খুনি জালিমের নিপীড়নকারী কঠিন হাত
কোনো দিনও চেপে দিতে পারবে না
তোমাদের সেই লক্ষদিনের আশাকে,
যেদিন আমরা লড়াই করে জিতে নেব
ন্যায়-নীতির দিন
হে আমার মৃত ভাইরা,
সেই দিন নিস্তব্ধতার মধ্য থেকে
তোমাদের কণ্ঠস্বর
স্বাধীনতার বলিষ্ঠ চিৎকারে
ভেসে আসবে
সেই দিন আমার দেশের জনতা
খুনি জালিমকে ফাঁসির কাষ্ঠে
ঝুলাবেই ঝুলাবে
তোমাদের আশা অগ্নিশিখার মতো জ্বলবে
প্রতিশোধ এবং বিজয়ের আনন্দে।
Comments
Post a Comment