রাসবিহারী বসু- The Unsung Hero

- তুমি ইতিহাস শিক্ষকের গায়ে কালি ঢেলে দিয়েছ কেন ?
ডুপ্লে কলেজের প্রিন্সিপ্যাল চারুচন্দ্র রায় খুব গম্ভীর ভাবে জিজ্ঞেস করলেন। সামনে দাঁড়ানো অপরাধী ছাত্রটির মুখ নিচু হলেও উদ্ধত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। জামার সামনের কিছু বোতাম খোলা; দেখা যাচ্ছে বুকের পাটা, চওড়া কাঁধ, কব্জি থেকে শক্তপোক্ত আঙুল .. ঠাকুরদার কাছে লাঠি চালানো অভ্যাস করে পেটান চেহারা, দেখতে বয়সের থেকে একটু বড় লাগে।
- উনি স্যার আমাকে রাসভ বলেন কেন ?
অবাক হয়ে চারুচন্দ্র রায় জিজ্ঞেস করেন - ক্লাসে এত ছেলে থাকতে তোমার নামটাই বা উনি এমন ডাকেন কেন ?
- না স্যার এটা ওঁর স্বভাব। সব ছাত্রের নাম বিকৃত করে কাউকে মর্কট, কাউকে বাঁদরেন্দ্র, কাউকে কেন্নো এইসব ডাকেন।
- তা বলে তুমি ওনার গায়ে কালি দেবে ?
- শুধু তাই নয়, উনি অপমান করে বলেছেন বাঙালীরা ভেরুয়া, বকতিয়ার খিলজি মাত্র সতেরো জন অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে এদেশ জয় করেছিল .. এ কি বিশ্বাসযোগ্য স্যার ?
তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে চারুচন্দ্র রায় তাকিয়ে থাকেন ছাত্রটির দিকে .. বলেন - এটাই তো ইতিহাস বইতে লেখা আছে।
- ও তো স্যার যারা জিতেছিল তাদের লেখা ইতিহাস।
আরো অবাক হয়ে স্যার জিজ্ঞেস করেন - তুমি রমেশচন্দ্র দত্তের 'বঙ্গবিজেতা' পরেছ ?
- না স্যার।
- ও .. তাহলে অন্য বই তেমন পড়া হয় না ?
- হ্যাঁ পড়ি .. রমেশচন্দ্র দত্তের অন্য বই পড়েছি। অন্য অনেক লেখকের বই পড়েছি।
- অন্য বই যা যা পড়েছ তার কোনও একটির নাম বলো .. তোমার ভালো লাগলো কোনটি ?
- বঙ্কিমচন্দ্রের 'আনন্দমঠ'।
চমকে উঠে ছাত্রের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন .. কিছু পরে চেয়ার ছেড়ে উঠলেন চারুচন্দ্র রায়, আলমারি থেকে বঙ্গবিজেতা বইটি ছাত্রের হাতে দিলেন, বললেন - সন্ধ্যের মধ্যে পড়া শেষ করে 'সুহৃদ সম্মিলনী' তে এসে ফেরত দিয়ে যাবে .. পরে বললেন, শিক্ষকের কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইবে, ক্ষমা না চাইলে আর কখনও ক্লাস করতে পারবে না।
- কিন্তু স্যার আমি তো সুহৃদ সম্মিলনী চিনি না ..
এবার বাইরে এক ঝলক দেখে চারুচন্দ্র রায় বললেন - এই ঘরের বাইরে ঐ থামের আড়ালে তোমার বন্ধু, ভাই শ্রীশচন্দ্র লুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে .. সে চেনে .. সে তোমাকে নিয়ে আসবে।

সেদিন বিকেলে দুই কিশোর শ্রীশচন্দ্র ঘোষ ও রাসবিহারী বসু সুহৃদ সম্মিলনী এলেন। সেখানে এক ঘটনায় পরিচয় হ'ল কিছু মাস আগে বোম্বে থেকে আসা আরএক কিশোর কানাইলাল দত্তের সাথে। সেদিন এই তিন কিশোরকে স্যার চারুচন্দ্র রায় পলাশির যুদ্ধের বর্ণনা শুনিয়ে ছিলেন। নিজের লোকেদের বিশ্বাসঘাতকতায় সিরাজউদৌলার পরাজয় নিশ্চিত, যুদ্ধের যখন প্রায় শেষ, স্যার লক্ষ্য করলেন, তিন কিশোরের ছাত্রের মুখের ভাব তিন রকম। চারুচন্দ্র রায় হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন - তোমরা তিনজন যদি পলাশিতে সেদিন উপস্থিত থাকতে, তোমরা কী করতে ?
শিরে ওরফে শ্রীশচন্দ্র বললে - যুদ্ধে হেরে গেছি জানলে আত্মহত্যা করতাম।
কনাইলাল দত্ত বললে - আমি নিজে মরতাম না .. সুযোগ মতো আমার শেষ গুলিটা নিয়ে ফিরে আসতাম মুর্শিদাবাদে, যেদিন মীরজাফরের দেখা পেতাম ওকে গুলি করে মারতাম .. তারপর যা হতো।
স্যার চারুচন্দ্র রায় এবারে তাকালেন রাসবিহারীর দিকে ..
এইসময় হঠাৎ রাসবিহারী উঠে দাঁড়ায়, জোড় হাত করে বলে - স্যার আমি ইতিহাস শিক্ষকের কাছে ক্ষমা চাইতে পারব না।
কী প্রশ্নের কী উত্তর !
চন্দননগরের বিপ্লবের আদিগুরু চারুচন্দ্র রায় খুবই নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলতেন। পরের দিন কলেজে দুজনের একান্তভাবে কথা হয়। ছাত্র রাসবিহারী ক্ষমা চাইবেন না .. তাই ডুপ্লে কলেজ থেকে তার নাম কাটা গেল। মাঝপথে অন্য কোনও স্কুলে ভর্তি নেবে না .. সেদিক খেয়াল রেখে অধ্যক্ষ চারুচন্দ্র রায় নিজে থেকে এক চিঠি লিখে ছাত্র রাসবিহারীর হাতে দিলেন, কলকাতা মর্টন স্কুলের প্রধান শিক্ষকের নামে, যাতে ওখানে গিয়ে মাঝপথে ভর্তি হতে পারে। তারপর আবার জিজ্ঞেস করলেন, কাল আমার প্রশ্ন এড়িয়ে গেলে কেন ?
কিশোর রাসবিহারী বললে - স্যার পলাশির যুদ্ধে বেঁচে থাকলে আমি ক্লাইভের দলে নাম লেখাতাম ..
স্যার চারুচন্দ্র অবাক হয়ে বললেন - বিশ্বাসঘাতকতা ! কিন্তু কেন ?
কিশোর ছাত্র রাসবিহারী চোয়াল শক্ত করে বললে - স্যার আমি ক্লাইভের এই রণকৌশলটা শিখতেই ওর দলে নাম লেখাতাম .. প্রথমে ওর বিশ্বাস অর্জন করতাম .. তারপর ওরই শেখান পথে ওকে ধনে-প্রাণে শেষ করে দিতাম .. বিশ্বাসঘাতক হব বলেই বিশ্বাসঘাতক হতাম।
*
*
ডবল ক্রসিং .. .. অধ্যক্ষ চারুচন্দ্র রায় অবাক চোখে তাকিয়ে থাকেন কিশোর ছাত্রের দিকে .. তিনি ভাবেন তাঁর এত বছরের বিপ্লবী জীবনে তিনি বহু বিপ্লবী কাজ গোপনে করে চলেছেন .. তবু তাঁর মাথায় যে চিন্তা কখনও আসেনি .. অথচ এই বয়সেই এই কিশোর ছেলেটির মাথায় তাই খেলা করে চলেছে .. .. .. "বিশ্বাসঘাতক হব বলেই বিশ্বাসঘাতক হতাম।"

মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসুর শুভ জন্মদিনে (মে ২৫, ১৮৮৬ - জানুয়ারি ২১, ১৯৪৫) জানাই আমাদের অন্তরের ভালবাসা ও হাজার কোটি প্রণাম ..
জয় হিন্দ্
-সোমনাথ.সিংহ@s.sinha
চিত্র - Rasbihari bos and Tagore When he Visited Japan 
তথ্য: @আমি রাসবিহারীকে দেখেছি- নারায়ণ সান্যাল।

Comments

Popular posts from this blog

বিভূতিভূষণ অভয়ারণ্য এবং ভূতুড়ে রাত্রিযাপন

★পঞ্চলিঙ্গেশ্বর

The Super Cyclone (Orissa, 1999) - the diary of A small boy