ফ্ল্যাট রহস্য - কেস নম্বর ২০


ফ্ল্যাট রহস্য - কেস নম্বর ২০

লেখা- সুবর্ণা মান্না

সন্ধ্যে হবে হবে করছে, নীলাঞ্জনাদেবী ড্রইং রুমে বসে টিভি দেখছেন। এমন সময় হঠাৎই তার মনে হল রান্না ঘর থেকে হাঁটা-চলা, বাসন নাড়াচাড়ার শব্দ আসছে। স্বামী রুদ্রবাবু বাইরে, দোকানে গেছেন। এখনো ফেরেননি, সদর দরজা বন্ধ। তার একমাত্র ছেলে ভিন রাজ্যে পড়াশোনা করছে। সুতরাং নতুন কেনা ফ্ল্যাটটিতে এই মুহূর্তে তিনি একা। রান্না ঘরে তবে কীসের আওয়াজ? নীলাঞ্জনাদেবী এমনিতে সাহসী, সহজে ভয় পান না। উঠে দেখতে গেলেন রান্নাঘরে। যত এগোচ্ছেন শব্দটি যেন ততই প্রকট হচ্ছে, রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে  উঁকি মারলেন ভেতরে। না, কোনো শব্দ নেই এখন। একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা যেন ঘিরে ধরেছে তার চারপাশে। হঠাৎ নিস্তব্ধতার বুক চিরে, কলিং বেলের তীক্ষ্ণ আওয়াজে  নীলাঞ্জনাদেবীর ঘোর কাটল। দৌড়ে গিয়ে সদর দরজা খুলে সব ঘটনা বললেন  রুদ্রবাবুকে। 

রুদ্রবাবু বিস্মিত হলেন না। আসলে এরকম ঘটনা এ বাড়িতে আসার পর অনেকবার লক্ষ্য করেছেন তিনি নিজেও। প্রয়োজনীয় জিনিস এক জায়গায় রাখলে অন্য জায়গায় খুঁজে পাচ্ছেন, কখনো এঘরে কখনো ওঘরে টুকটাক, ফিসফাস আওয়াজ..। আবার, সামনে রাখা জিনিস উধাও হয়ে কিছুদিন পর তা খুঁজে পাওয়া গেল আগের জায়গাতেই। এই ঘটনা অস্বাভাবিক হলেও মিত্র দম্পতি রোজকার রুটিনে এটা স্বাভাবিক বলেই মেনে নিয়েছিল। বাধ সাধল একদিন রাতের ঘটনা।

প্রায় মাঝরাত, কথপোকথনের ফিসফিস আওয়াজে নীলাঞ্জনাদেবীর ঘুম ভেঙে গেল। চোখ না খুলেই কান খাড়া করে শুনলেন, ঘরের ভেতরেই কারা যেন অসস্পষ্ট স্বরে কথা বলছে। শব্দ অনুসরণ করে চোখ খুলে নাইট ল্যাম্পের আবছা আলোয় দেখলেন, ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে রয়েছে আবছা একটা ছায়ামূর্তি। চোর ভেবে রুদ্রবাবুকে ঠেলে জাগিয়ে দিতে রুদ্রবাবুও ছায়ামূর্তিটি দেখে বেড সুইচ অন করলেন।কিন্তু কোথাও কিছু নেই! সবকিছু মুহূর্তে মিলিয়ে গেল দেওয়ালের কোণে। 

মিত্র দম্পতি আর দেরি করলেন না, গুগল থেকে আমাদের ফোন নম্বর খুঁজে পরেরদিন সকালেই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। আমরা ঘটনা শুনেই রাজি হয়ে গেলাম ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে। 

দু'চারদিন পর এক রবিবার আমি আর দীপাঞ্জন হাজির হলাম নিউটাউনের ওই নতুন ফ্ল্যাটের সামনে। টুবাইয়ের কাজ ছিল, তাই আসেনি সঙ্গে।

ঝাঁ চকচকে পরিবেশ, সুসজ্জিত ফ্ল্যাটের ভিতরে আমরা প্রবেশ করলাম। মিত্র দম্পতি আমাদের আপ্যায়ন করে বসালেন, সমস্ত ঘটনা পুনরায় বললেন। সবটা শোনার পর আমরা প্রথমে ঘরগুলো ঘুরে দেখলাম। তার পর ঘরের মেন সুইচ অফ করলাম, যাতে আনওয়ান্টেড কোনো সিগনাল না আসে ই-এম-এফ মিটারে। একটা ঘরে আমাদের সি-সি-টিভি ক্যামেরা লাগিয়ে রাখলাম, যদি কিছু ধরা পরে। আর একটা ঘরে আমরা যোগাযোগ করার চেষ্টা চালালাম। 

শুরু করার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের সামনে রাখা ই-এম-এফ মিটারে আলো জ্বলে উঠল। আমরা ই-এম-এফ মিটারের পাশে রাখা ভয়েস রেকর্ডারে শুরু করলাম বিভিন্ন প্রশ্ন। পরক্ষণেই বুঝতে পারলাম আমরা চারজন বাদেও এই ঘরে আরও কেউ রয়েছেন, যিনি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছেন। আমরা তাকে উদ্দেশ্য করে আরও প্রশ্ন করলাম, এই যেমন, “আপনি কি আমাদের সঙ্গে কথা বলতে চান? আপনি কি জানেন আমরা কেন এসেছি? আপনি কি বলতে পারবেন, আমরা এই ঘরে কতজন রয়েছি?” মোটামুটি সব প্রশ্নেরই সঠিক উত্তর আমরা  পরিষ্কার শুনতে পেলাম ইকোভক্স মেশিনে। 

দীপাঞ্জনের নামটা এতটাই পরিষ্কার উচ্চারণ করল যে মনে হল অশরীরী নয়, কোনো মানুষ যেন আমাদের সামনে এসে কথা বলছে। আমার নামও একবার বলল আটকে আটকে। যখন জিজ্ঞাসা করলাম, “আমরা কতজন এই ঘরে রয়েছি?”, 
উত্তরটি পরিষ্কার কানে এল, "চার"। এরপর যখনই বললাম আমরা আপনাকে সাহায্য করতে এসেছি, অশরীরীর উত্তর আসে, “গুড বাই”।

আমাদের ইনভেস্টিগেশনের কতগুলি ধাপ রয়েছে। ভয়েস তো পাওয়া গেল, অশরীরীর উপস্থিতির আরও প্রমাণের উদ্দেশ্য আমরা ‘অবজেক্ট মুভমেন্ট' শুরু করলাম। প্রথমে পুরো রুমের জানালা-দরজা বন্ধ করলাম, যাতে না বাইরের কোন বাতাস ঘরের ভিতর প্রবেশ করতে পারে। তার পর আমরা একটা বল মেঝের উপর রেখে তার পাশে আমাদের কম্পাস রাখলাম, এবং বলটি নাড়াতে নির্দেশ দিলাম, বল হালকা নড়ল। যদিও একটুও বাতাস ছিল না ঘরের ভিতরে। আমাদের কম্পাসে সামান্য মুভমেন্ট দেখতে পেলাম। এই সময় আমাদের চমকে দিল কিছু শব্দ। আমাদের ঘরের দরজার বাইরে কারোর হেঁটে বেড়ানোর শব্দ। কিন্তু কী করে তা সম্ভব! আমরা ছাড়া ভেতরে আর কেউ নেই, বাইরে থেকেও কারোর আসার সম্ভাবনা নেই। কারন সদর দরজা তো আমরাই লক করে এসেছি। বুঝলাম ওনাদের কথাগুলো ঠিক ছিল।

এবার অন্য ঘরটির পালা, যে ঘরে আমাদের ক্যামেরা লাগানো রয়েছে। ওই ঘরে ঢুকে দেখলাম, ক্যামেরা তখনও চলছে। কিন্তু যখন ভিডিও প্লে করলাম, দেখলাম ভিডিওতে অনেকবার অর্বস  ধরা পরেছে। একটা আত্মা বিভিন্নভাবে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন, বা বলতে পারেন অনেকরকম ভাবে আমাদেরকে ওনাদের উপস্থিতি বোঝানোর চেষ্টা করে থাকে। যার মধ্যে অর্বস  একটি পদ্ধতি। ছোট ছোট রঙিন বিন্দুর মতো কিছু বস্তু ক্যামেরায় ধরা পড়ে। সেটাই অর্বস বলে মনে করা হয়।  
যাই হোক, আমাদের সব পদ্ধতি প্রয়োগ করে বুঝলাম সত্যি সত্যি ওই ফ্ল্যাটে কোনো এনার্জি বাস করছে আগে থেকেই। যদিও মানুষের পৃথিবী থেকে ওদের পৃথিবী অনেক পৃথক, তবুও কখনো কখনো সীমারেখা বদলে যায়। ওরা ফিরে আসে মানুষের সাম্রাজ্যে ওদের অস্তিত্ব প্রকাশের আশায়…. আর আমরা তখন তাকে ভূতুড়ে বলি।

মিত্র দম্পতি আমাদের সঙ্গে থেকে সমস্ত কিছু দেখলেন, বুঝলেন। ওনারা স্থির  করলেন এই ভুতুড়ে ফ্ল্যাট ছেড়ে অন্যত্র চলে যাবেন। পরে খবর নিয়ে মিত্র দম্পতি জেনেছিল যে ওই ফ্ল্যাট তাঁদের আগে যাঁদের বাসস্থান ছিল, তারা এক দক্ষিণ ভারতীয় পরিবার। বাবা-মা চাকরি সূত্রে বাইরে ছিল। তাঁদের দুই ছেলে মেয়ে, বয়স ১৬-র আশপাশে ঘরেই ছিল। এক ঝড়ের রাতে শট সার্কিট থেকে সুইচ বোর্ডে বৈদ্যুতিক শক খেয়ে দু'জনেরই দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু হয়। পরে ওই পরিবার ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়েছিলেন।

সম্প্রতি গোটা পশ্চিমবাংলাই বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ের সাক্ষী থেকেছে। প্রাণ হারিয়েছে অনেকেই। ভাবলে খারাপ লাগে, ওটাও তেমনই এক ঝড়ের রাত ছিল যেবার দু'জন কিশোর বেঘোরে মারা যায়। মিত্র দম্পতি ওই ফ্ল্যাটে প্রায় ৩ বছর ছিলেন। ওই সময়ে কমবেশি অনেকবারই অশরীরী উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করেছিল তারা। তবে নিজেরাও স্বীকার করেছেন ওই অশরীরী শক্তি কখনও তাদের ক্ষতি করেনি।

----------------------------------------------------------------------

Batanagar Paranormal Society -কে ধন্যবাদ তাদের অভিজ্ঞতা আমাদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার জন্য।

Comments

Popular posts from this blog

বিভূতিভূষণ অভয়ারণ্য এবং ভূতুড়ে রাত্রিযাপন

★পঞ্চলিঙ্গেশ্বর

The Super Cyclone (Orissa, 1999) - the diary of A small boy