শহরতলির বিভীষিকা
কলমে শ্যামলিমা
কলকাতা সংলগ্ন শহরতলি বা গ্রামাঞ্চলে এলাকায় ঝড় মানে - আধ ঘণ্টা বাজ পড়বে, ভীষণ বৃষ্টি হবে, দুটো-পাঁচটা তার ছিঁড়বে, একটা পাড়ার পোস্ট ভেঙে পড়লে, - টর্চ নিয়ে সবাই এক হয়ে গিয়ে দিন রাত এক করে আলো আনার চেস্টা করবে। তাও যদি কারো বাঁশ গাছে কারেন্টের তার ঠেকে থাকে অথবা পুকুরপাড়ের কোনো আমড়া গাছের ডালে তার প্যাঁচিয়ে গিয়ে থাকে তো হলো! ঝড়-মাথা তেই ছাতা হাতে, বর্ষাতি সমেত গাছগুলো কাটতে যেত পাড়ার সব কাকুরা।৷
দুটো পাড়ার দুটো আলাদা ফেজ থাকলে দৌড়ে গিয়ে একজন আলো এলো নাকি খোঁজ নিয়ে আসতো, অথবা মাঝে পুকুর থাকলে এক পাড়ার কাকু বাবার নাম ধরে জিজ্ঞেস করতো- 'কি রে তোদের আলো এলো?' অথবা দূর ল্যাম্পপোস্টটা কে মার্ক করে সবাই বুঝে নিত আজ আলো আসবে কিনা? পাশের বাড়ির মেয়েটির পড়ার ঘরের একটাই টিউবলাইট জ্বলছে কিনা সেটা দেখে বোঝা যেত, - আমার বাড়িরই ফিউজ উড়েছে? নাকি,গোটা পাড়াই আজ ভোগে গেছে।
পোস্টের মাথায় সাদা টর্চের আলো দেখে তাকে তাকে থাকা হতো, যে ঐ সাপ্লাই এর লোক এল নাকি? মাটির ঘরের ছোটো ছেলেটাও জানলা ধরে বসে থাকতো সামনে হ্যারিকেন নিয়ে। কারুর একটা ছোটো ঘরে জ্বলতো একটা ইমারজেন্সি লাইট। শোওয়ার ঘরের জানলার হাঁসকল টা যাতে ভেঙে না যায় তার জন্য তার বিয়েতে বাপের বাড়ি থেকে পাওয়া টিনের ট্রাঙ্কটায় ঠেকনা দিয়ে আপ্রান চেস্টা করে যেত বাড়ির কাকিমা।অথবা সিন্দুক টা সরিয়ে নিয়ে দরজার সামনে রেখে দিত গ্রামের স্বপন দাদু। এর মধ্যে মাথায় গামছা দিয়ে কিছু ডেপো ছোকরা বেড়িয়ে যেত বালতি আর হ্যারিকেন নিয়ে আম কুড়াতে, সেগুলোকে তাড়াও রে!! - যদি মুখ চিনে নিয়েছে কি পরদিন সে কি মার। দু-চারটে তো থাকতোই সাপে কাটার ঘটনা, ঐ রাতেই কারো ভ্যান জোগাড় করে তাকে গ্রামীন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যেতে যেতেই সে হয়তো দমকা হাওয়ার সাথে প্রান হারাতো।কারো চাল উড়ে গেলে ঐ রাতেই ত্রিপল খোঁজার জন্য রে রে রব পড়তো,ঘরগুলো তো বাঁচানো চাই। কারুর উঠোনে পেঁপেঁ গাছটা উল্টে গেলে ঝড় যাওয়ার পর ঝুড়ি ভরে সবাই মিলে তুলতে পারাটাও ছিল কষ্টসাধ্য, - যদি পরদিন হাটে এগুলো বেচে কিছু পাওয়া যায়। সব ঘূর্ণি থেমে গেলে হাতপাখা দিয়ে হাওয়া খেতে খেতে ভাত মুখে তুলতো পাড়ার ছোট্টু। যার ধানের বস্তায় ক্ষয়ক্ষতি হয়নি, সে হয়তো সেই রাতে স্বস্তির ঘুম ঘুমাতো।
....এসবের সময় কালেও প্রান সংশয় হয়ে যাবে, আর বাঁচব না, এরম কখনো মনে হয়নি। ফোন না থাকলেও সবাই সুস্থ থাকবে এই আশা তো ছিলোই, যেটা আজ ফোনের নেটওয়ার্ক না পাওয়ার পর ছিলো না। এত ভয় সত্যি জীবনে পাইনি, যখন দেখলাম একের পর এক টুনটুনি ঘরে ঢুকছে, প্রানের আশঙ্কায় ছোটাছুটি করছে।আবহাওয়ার পরিবর্তনের জন্য অনেক নিম্নচাপের সম্মুখীন হয়েছি ঠিকই, কিন্তু এমন ঝড় আমি কেন আমার বাবা কাকা রাও খুব কম দেখেছেন। একে ওকে করা টেক্সটাও যখন নেটের অভাবে যাচ্ছে না,তখন ভাবলাম প্রকৃতির এই ক্লাসে কি সত্যিই " পাশ করবো না আমরা? করব না আমরা পাশ " -সুপারি গাছগুলোর মট মট শব্দ প্রিয়জন বিয়োগের সমানই আজ মনে হচ্ছিল, ওরা যে পুকুর পাড়ে এত বছর সীমান্তরক্ষীর মতো দাঁড়িয়ে ছিল। পাশের পাড়ার চেনা ছেলেটা এবছরই মাটির বাড়ি ছেড়ে নতুন বাড়ি করবে বলে ভেবেছিল, সব তো জলে গেল, এখন সে সব হারিয়ে অন্য একটি বাড়িতে আশ্রয়রত, আর একটুর জন্য টালির চাল টা তার মাথায় পড়েনি। আম গুলো পেড়ে আর দিন কয়েকের ভিতর জাগ দেবে ভেবেছিল প্রবীরদা, সে আম গাছের পুরোটাই এখন জলে, সকাল না হলে কিছু করাও যাবে না। সব লন্ডভণ্ড। কতদিকে কি ক্ষতি হয়েছে জানি না, কতজন মা আজ ছেলে হারাল জানি না, কত জনের লাখ টাকার অঙ্ক আমফান নষ্ট করে গেল জানি না, কত বুলবুলির বাসা আজ সর্বনাশি গিলে খেল জানি না, কত জনের দেহ আজ বিদ্যুৎপৃষ্ট হলো জানি না। শুধু জানি, একদিন সব ঝড় থেমে যাবে,সব টুনটুনি তার নিজের বাসায় বাচ্চাকে আদর করবে, সবার সব ঋন শোধ হবে, ছেলেটা মাটির বাড়িটা পাকা করে নিতে পারবে, কতো সুপারি গাছ আবার জেগে উঠবে সবার রক্ষাকর্তা হিসেবে, এই রাত ও কেটে যাবে। আবার বেড়ে উঠবো আমরা, আবার বেঁচে উঠবো আমরা!!
Comments
Post a Comment